বৃক্ষরোপণ সনাতন ধর্মে একটি পবিত্র ব্রত হিসেবে চিহ্নিত। বেদাদি বিভিন্ন শাস্ত্রে প্রকৃতি রক্ষার কথা আছে। বৃক্ষরোপণের কথা আছে। শিবপুরাণ শৈব সম্প্রদায়ের বেদ পরবর্তী প্রধান ধর্মগ্রন্থ। এ শিবপুরাণের সনৎকুমার সংহিতায় বৃক্ষরোপন প্রসঙ্গে বলা হয়েছে:
যস্তু বৃক্ষঞ্চ কুরুতে চ্ছায়াপুষ্পকলান্বিতম্ ।
পথি দেবনরঃ সৌম্য স তারয়তি বৈ পিতৃন্ ॥
(শিবপুরাণ: সনৎকুমার সংহিতা,২৫.২৯)
"যে ব্যক্তি রাজপথে পথিকদের ছায়ার জন্যে পথের দুপাশে বিভিন্ন প্রকারের ফুল এবং ফলের বৃক্ষ রোপণ করেন তিনি মনুষ্যদেহেই দেবতাতূল্য সম্মান লাভ করে তার পিতৃপুরুষদের উদ্ধার করেন।"
আরো পড়ুন- C প্রোগ্রামিং শিখুন একদম ফ্রিতে
জীবনী
কর্নাটকের গুব্বি তালুকের লিঙ্গায়েত শৈব সম্প্রদায়ের এক জগদ্বিখ্যাত নারী হলেন, সালুমারাদা থিম্মাক্কা ।২০১৬ সালে বিবিসির বিচারে বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী নারীদের তালিকায় রয়েছেন সালুমারাদা থিম্মাক্কা। তাঁর নাম আদর্শকে অনুসরণ করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে প্রতিষ্ঠান।
তাঁর অবদান, তিনি ৮০ বছরব্যাপী শুধু বৃক্ষরোপণ করেছেন।গত ৮০ বছরে তিনি প্রায় ৮ হাজার বৃক্ষ রোপন করেছেন।এই মহীয়সী নারীর জন্ম কর্ণাটকের গুব্বি তালুকের তুমকুরে ১৯১০, (মতান্তরে ১৯১১) খ্রিস্টাব্দে। তিনি নিজগ্রাম হুলিকাল থেকে কুদুর অবধি ৩৮৫ টি বট- অশ্বত্থ বৃক্ষের চারা লাগিয়ে বড় করে তুলেছেন। তাঁর স্বামীর নাম বেকাল চিক্কাইয়া। তাঁরা নিঃসন্তান ছিলেন।
সন্তান না হওয়ায় সালুমারাদা থিম্মাক্কা স্বামীকে সাথে নিয়ে একটি অনন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। প্রতিদিন বৃক্ষ রোপন করবেন এবং সেই বৃক্ষদের সন্তানস্নেহে বড় করে তুলবেন। গ্রাম থেকে প্রতিদিন প্রায় চার কিলোমিটার অতিক্রম করে তারা গাছগুলোকে দেখাশোনা করতেন। জল দিতেন, পরিচর্যা করতেন। বিভিন্ন গবাদি পশুর হাত থেকে চারাগাছগুলোকে বাঁচাতে কাঁটাতারের বেড়াও তৈরি করে দেন।
প্রথম বছরে ১০টি, দ্বিতীয় বছরে ১৫টি, তৃতীয় বছরে ২০টি বটগাছের চারা লাগালেন। বৃক্ষ নামক সন্তানদের দেখাশোনার জন্য দিনমজুরির কাজও ছেড়ে দেন স্বামী চিক্কাইয়া। প্রায় চার কিলোমিটার পথজুড়ে ছায়াময় সুবিশাল বৃক্ষগুলো সালুমারাদা থিম্মাক্কা এবং চিক্কাইয়ার নিঃস্বার্থ প্রকৃতি প্রেমের এক অনুপম দৃষ্টান্ত।
প্রকৃতিতে বৃক্ষের ফল, ফুল এবং সর্বোপরি অক্সিজেন কতটা প্রয়োজনীয়, তা করোনাকালে নাগরিক জীবনের মানুষেরা হাড়েহাড়ে টের পেয়েছে। দীর্ঘ পথ বিস্তৃত এ বৃক্ষের সারিতে আজও পথচারী মুগ্ধ হয়, বৃক্ষের ছায়াতে বিশ্রাম নেয় । ১৯৯১ সালে স্বামী চিক্কাইয়া মৃত্যুবরণ করেন। স্বামীর যুগপৎভাবে যে কাজ শুরু করেছিলেন, স্বামীর মৃত্যুতে থেমে থাকেনি থিম্মাক্কার।
স্বামীর শূন্যতাকে সঙ্গী করে একলাই চালিয়ে যান বৃক্ষরোপন। বয়স তাঁকে সামান্যতম দমাতে পারেনি। আজ ২০২১ সালে এসে প্রায় ১১১ বছরের দীর্ঘ জীবন তাঁর। সাথে বৃক্ষের মত দৃঢ় হৃদয়। যে দৃঢ়হৃদয়ে, প্রকৃতির ভালোবাসাকে জয় করে, তিনি পৃথিবীর মানুষের ভালোবাকে জয় করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত হয়েছেন।
বর্তমানে সালুমারাদা থিম্মাক্কার রোপন করা বৃক্ষগুলোকে দেখাশোনার দায়িত্ব নেয় কর্নাটক সরকার। প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত সালুমারাদা থিম্মাক্কা।বৃক্ষের প্রতি অনন্য ভালোবাসার জন্যে তাঁকে 'বৃক্ষমাতা' নামে অবিহিত করা হয়।
সালুমারাদা থিম্মাক্কা ১৬ মার্চ, ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে পরিবেশ রক্ষা ও উন্নয়নের স্বীকৃতি স্বরূপ ভারতের রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ থেকে পদ্মশ্রী সম্মানে বিভূষিত হয়েছেন। পদ্মশ্রী ছাড়া বহু আন্তর্জাতিক পুরস্কার পেয়েছেন এই বৃক্ষমাতা।
সালুমারাদা থিম্মাক্কার অনন্য কীর্তি প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'বলাকা' কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি পঙক্তি মনে পড়ে যায়। তা হলো:
"তোমার কীর্তির চেয়ে তুমি যে মহৎ,
তাই তব জীবনের রথ
পশ্চাতে ফেলিয়া যায় কীর্তিরে তোমার
বারম্বার।"
কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী
সহকারী অধ্যাপক,
সংস্কৃত বিভাগ,
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়